প্রাপ্ত বয়স্ক অর্থাৎ ৯-১৩ বছরের মধ্যে গোনাডোট্রফিক হরমোন (GTH) এর প্রভাবে মেয়েদের নিয়মিত প্রায় ২৪-৩২ দিন পর পর জরায়ু থেকে রক্ত, মিউকাস, এন্ড্রোমেট্রিয়াম ও অনিষিক্ত ডিম্বানুর ধ্বংস বা ক্ষরণ হওয়ার চক্রীয় নিষ্কাশনকে পিরিয়ড, মাসিক, ঋতু স্রাব বা রজঃচক্র বলে।
পিরিয়ড ৯-১৩ বছর বয়সের মধ্যে শুরু হয়। ৪৫-৫৫ বছর বয়সের মধ্যে পিরিয়ড স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায়; যাকে মনোপজ বলে।
পিরিয়ড কেন হয়?
পিরিয়ড মূলত মেয়েদের প্রজনন ক্ষমতার সূচনা ঘটায়। সন্তান ধারন ক্ষমতা নির্দেশ করে প্রতিমাসে একবার গর্ভধারনের সুযোগ সৃষ্টি করেন।
বয়ঃসন্ধিকালে একটি মেয়ের ডিম্বাশয়ে প্রায় ৩-৪ লক্ষ অনিষিক্ত ডিম্বাণু থাকে।
অগ্র মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস ও পিটুইটারি গ্রন্থিতে ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন নিঃসৃত এর মাত্রা কমে যাওয়ার জন্য এন্ডোমেট্রিয়ামের আর বৃদ্ধি ঘটে না। রক্তের অভাবে তখন এন্ডোমেট্রিয়ামের ধমনী প্রসারিত হয়। যার জন্য ধমনী ও কৈশিক নালিকা ভেঙে যোনিপথ দিয়ে রক্ত ক্ষরণ শুরু করে।
পিরিয়ডের ব্যথা হয় কেন?
পিরিয়ডের সময় প্রোস্টাগ্লান্ডিন হরমোনের প্রভাবে জরায়ু সংকুচিত হয়ে যায়। যাদের শরীরে প্রোস্টা গ্রান্ডিন মাত্রাতিরিক্ত থাকে তাদের মূলত ব্যথা হয়। তবে সবার যে পেট ব্যথা হবে এমনটাও না। পিরিয়ড শুরু হওয়ার এক সপ্তাহ আগে থেকে কিছু লক্ষণ প্রকাশ পাওয়া যায়। যেমন- মুড সুইং, স্তন ব্যথা, কোমর ব্যথা, তলপেট ব্যথা, জ্বর, মুখে ব্রন, বমি বমি ভাব, খাবারে অরুচি, মাথা ঘোরা, হাত পা ঝিনঝিন করা ইত্যাদি।
আরও দেখুন: সেক্সে রসুনের উপকারিতা কি?
পিরিয়ডের সময় মুড সুইং কেন হয়?
পিরিয়ডের সময় শরীরে সেরোটোনিন হরমোনের মাত্রা অধিক বেড়ে যায়। সেরোটোনিন হরমোন মূলত আমাদের মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। সেরোটোনিন হরমোন শরীরে বেশি থাকলে মানুষ হীনমন্যতায় ভোগে। যেহেতু পিরিয়ডের সময় এটি বেশি পরিমাণে নিঃসৃত হয় তার জন্য ছোটো ছোটো বিষয়গুলো নিয়ে নারীরা বেশি সংবেদনশীল হয়ে যায়। এই সময় পরিবারের অন্য সদস্যদের সাপোর্টিভ হতে হবে।
পিরিয়ড এর ব্যথা কতক্ষণ স্থায়ী হয়?
সাধারণত ২৪-৪৮ ঘন্টার মধ্যে পিরিয়ডের ব্যথা কমে যায়। পিরিয়ড ৪-৫ দিন স্থায়ী হয়ে থাকে। সাধারণত একজন নারীর পিরিয়ডের সময় ৩০-৯০ মি.লি. রক্তক্ষরণ হয়ে থাকে।
পিরিয়ডের ব্যথা কমানোর উপায় কী?
প্রায় সব নারীর কম বেশি মাসিকের ব্যথা হয়ে থাকে। এই সময় অনেকে ব্যথানাশক ঔষুধ সেবন করে থাকেন। ব্যথানাশক ঔষুধ দীর্ঘদিন যাবৎ সেবন করলে সন্তান ধারণ ক্ষমতা হ্রাস পায়। তাছাড়াও বেশি দিন ব্যথানাশক ঔষুধ সেবনের ফলে কিডনি বিকল থেকে শুরু করে অনেক জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
তবে ব্যথা কমাতে ‘প্যারাসিটামল’ জাতীয় ওষুধ সেবন করা যাবে। এতে বিশেষ কোনো ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। অধিক ব্যথা হলে গুগলের পরামর্শ না নিয়ে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শে ঔষুধ খেতে হবে।
আরও দেখুন: জন্ডিসের লক্ষণ: জন্ডিস হলে করণীয় কী?
পিরিয়ড হলে কি খাওয়া উচিত?
পিরিয়ডের সময় মেয়েদের পুষ্টিকর খাবার খাওয়া অত্যন্ত জরুরি। কারণ এই সময় প্রচুর শারীরিক ও মানসিক স্ট্রেস হয়ে থাকে। যা যা খেতে হবে:
- আনারস: অনেক নারীর পিরিয়ডের সময় যোনিপথে রক্ত জমাট বেঁধে থাকে। এই সময় আনারস খেলে রক্তক্ষরণ ভালোভাবে হয়ে থাকে এবং যোনিপথ পরিস্কার থাকে।
- তরমুজ: পিরিয়ডের ব্যথা কমাতে সাহায্য করে।
- আদা: পিরিয়ডের সময় জরায়ুর ফোলাভাব ও ব্যথা কমাতে সাহায্য করে।
- বিটরুট: বিটরুটে প্রচুর পরিমাণে আয়রন থাকে যা রক্ত তৈরিতে সাহায্য করে এবং শরীরের এনার্জি বাড়িয়ে দেয়।
- লেবু: মুড সুইং কমাতে সাহায্য করে।
- ডার্ক চকলেট: বিষণ্ণভাব দূর করে।
তাছাড়া ডিম, কবুতর মাংসের পাতলা ঝোল, শিং মাছের ঝোল, শাক-সবজি খেতে হবে যা রক্তশূন্যতা দূর করবে এবং শরীরে এনার্জি দিবে। এবং প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে।
পিরিয়ডের সময় কী কী খাওয়া যাবে না?
পিরিয়ডের সময় কিছু কিছু খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। যেমন- অতিরিক্ত চিনি ও লবণ, কোল্ড ড্রিংকস, আইসক্রিম, টক জাতীয় খাবার, শসা, নারিকেল, কফি, চিজ, দুধ ইত্যাদি।
পিরিয়ডের ব্যথা কমানোর ঘরোয়া উপায়?
যেহেতু পিরিয়ড নারীদের জন্য একটি সেনসিটিভ ইস্যু। তাই অনেকেই ওষুধ খাওয়া থেকে বিরত থেকে ঘরোয়া উপায়ে ব্যথা নিরাময় করার চেষ্টা করেন।
- গরম পানির সেঁক: পিরিয়ড হওয়ার পর হট ওয়াটার ব্যাগে নিয়ে তলপেটে সেঁক নিলে অনেকটা আরাম পাওয়া যায় এবং ব্যথা ধীরে ধীরে কমে আসে।
- আদা: পিরিয়ডের ব্যথা কমাতে আদার রস বেশ উপকারী। আদার সঙ্গে মধু গরম পানি যোগ করে ২-৩ বার খেলে ব্যথা অনেকটা কম অনুভব হবে।
- পেঁপে: পিরিয়ডের ব্যথা নিরাময়ের জন্য কাঁচা-পাকা পেঁপে খুব উপকারী।
- ব্যায়াম: পিরিয়ডের ব্যথার জন্য ব্যায়াম করাটা খুবই কষ্টকর হয়ে যায়। এই সময় হাঁটা চলা কষ্টের হলেও হাঁটা চলা করতে হবে। সহজ-সরল যোগব্যায়াম করা যেতে পারে। ব্যায়াম করলে এন্ডোফিন নিঃসৃত হয়; যা পেশির মোচড়ভাব কমিয়ে আনে।
মাসিকের ব্যথা কমানোর দোয়া
বাংলা উচ্চারণ: আউজু বি-ইজ্জাতিল্লহি ওয়া কুদরাতিহি মিন শাররি মা আজিদু ওয়া উহাজিরু।আরবি
অর্থ: আল্লাহর নামে আমি আল্লাহর অসীম সম্মান ও তাঁর বিশাল ক্ষমতার অসিলায় আমার অনুভূত এই ব্যথার ক্ষতি থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।
উপকার: একদা রাসূল (সা.)-এর কাছে উসমান বিন আবুল আস সাকাফি (রা.) মারাত্মক ব্যথা নিয়ে উপস্থিত হন। রাসূল (সা.) তাকে বললেন তুমি তোমার ডান হাত ব্যথার স্থানে রেখে এই দোয়া ৭ বার পাঠ কর। (ইবনে মাজাহ, হাদিস: ৩৫২২)
আরও দেখুন: পাত্র নির্বাচনে করণীয়: কেমন ছেলে বিয়ে করা উচিত
পিরিয়ডের সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা
বাংলাদেশের ৮২% নারীর ঋতুস্রাবকালীন পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে স্পষ্ট কোন ধারণা নেই।
বাংলাদেশের ১৬% নারী স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করে থাকে এবং ৮৪% নারী কাপড় বা ন্যাকড়া ব্যবহার করে থাকে। ১৬% স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারকারীর মধ্যে ৩৭% নারী শহরের এবং ১০% নারী গ্রামের।
এই সময় নিয়মিত গোসল ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। ঋতুস্রাবের সময় ৪-৫ ঘন্টা পর পর স্যানিটারি ন্যাপকিন বা কাপড় পরিবর্তন করতে হবে। এর বেশি সময় থাকলে যোনিতে ফাঙ্গাল ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
পিরিয়ডের সময় অনেকে যোনি পরিষ্কার করার জন্য সাবান ব্যবহার করে থাকেন। যার ফলে যোনি পথে PH মান হ্রাস পায়।
যোনি পরিষ্কার করার জন্য সাধারণ পানিই যথেষ্ট এবং পিরিয়ডের সময় হালকা কুসুম গরম পানি দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে।
পিরিয়ড বা মাসিক বাংলাদেশের নারীদের জন্য খুবই লজ্জার বিষয় বলে মনে করা হয়। তাদের কোনো সমস্যা হলে কারো সঙ্গে খোলামেলাভাবে আলোচনা না করে গোপন রাখার চেষ্টা করেন। এতে তাদের প্রজননের ক্ষেত্রে নানাবিধ সমস্যায় ভুগতে হয়। এই ট্যাবু থেকে সবাইকে বের হয়ে আসতে হবে এবং সঠিক পরামর্শ নিয়ে সুস্থভাবে জীবনযাপন করতে হবে।